বিশ্বব্যাপী মরণ ভাইরাস করোনায় আক্রান্ত হয়ে যখন লক্ষ লক্ষ প্রাণ ঝড়ে যাচ্ছে, তখন সবাই প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে এই রোগের প্রতিষেধক বা নিরোধক আবিষ্কারের জন্য। এই পর্যন্ত প্রায় হাজারখানেক ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ডব্লিউএইচওতে (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায়) নিবন্ধিত হয়েছে।
রেমডেসিভিরের ব্যবহারে আদৌ কি কোনো লাভ আছে, সেটা নিয়েই আজ আমার এই লেখা।
রেমডেসিভির কী?
আরও পরিষ্কার করে বললে বলা যায়, ভাইরাসের বংশ বৃদ্ধির জন্য যে নিউক্লিওসাইড দরকার, সেখানে এই “ফেক বা ভেজাল” নিউক্লিওসাইড দেয়া হচ্ছে। আসল নিউক্লিওসাইড না পাওয়ার ফলে ভাইরাস আর বংশ বৃদ্ধি করতে পারছে না।
অন্য কথায় এটা করোনাভাইরাসের আরএনএ পলিমারেজ এনজাইমের কাজ ব্লক করে দিয়ে ভাইরাসের বংশবৃদ্ধি (রেপ্লিকেশন) হতে বাধা দেয়। কথাটি বলতে সহজ মনে হলেও; ঠিক ভাইরাসের রেপ্লিকেশনের স্থানটিতে “ফেইক” জিনিস পৌঁছে তার বংশবৃদ্ধি থামানো অত সহজ নয়। তারচেয়ে ও বিপজ্জনক সমস্যা হল, এই নকল নিউক্লিওসাইড ভাইরাসের জিনে নতুন মিউটেশন তৈরি করে অ্যান্টিভাইরাল রেজিসটেন্স তৈরির আশংকা সৃষ্টি করে।
রেমডেসিভির প্রয়োগের প্রাথমিক পরীক্ষার ফলাফল কী?
যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক গিলিয়াড সায়েন্স (Gilead Sciences, Inc.) কোম্পানীর অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ রেমডেসিভির যুক্তরাষ্ট্রের ১,০৬৩ রোগীর ওপর প্রয়োগ করে দেশটি যে রেজাল্ট পেয়েছে তা কোনো জার্নালে প্রকাশিত হয়নি।
পরীক্ষায় তারা কোভিড-১৯ রোগীদের দুটি গ্রুপে ভাগ করে এক ভাগকে রেমডেসিভির দিয়ে চিকিৎসা করেছেন, আরেক গ্রুপকে রেমডেসিভির ছাড়া সাধারণভাবে চিকিৎসা করেছেন।
দুই গ্রুপের মাঝে রেমডেসিভির দেওয়া গ্রুপ গড়ে ১১ দিনে সুস্থ হয়েছেন আর অন্য গ্রুপ গড়ে ১৫ দিনে। দুই গ্রুপ থেকেই রোগী মারা গিয়েছেন এবং রেমডেসিভির দিয়ে মৃত্যুর হার কমানোর কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
শুধুমাত্র যারা হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে ফিরেছে, তাদের ক্ষেত্রে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হওয়ার সময়টা গড়ে চার দিন কম লেগেছে। প্রস্তুতকারী কোম্পানির প্রেস বিজ্ঞপ্তি এবং সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এ তথ্য জানানো হয়েছে এবং এ বিষয়ে আরও বর্ধিত আকারে পরীক্ষা করার সুপারিশের কথা জানানো হয়েছে।
এর আগে চীনেও কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় রেমডেসিভির ব্যবহার করা হয়েছিল। কিন্তু চীনা বিজ্ঞানীরা সন্তোষজনক ফল পাননি। এই অ্যান্টিভাইরাল ঔষধটি ইতিপূর্বে এইডস, হেপাটাইটিস সি ও ইবোলার চিকিৎসার জন্যও ব্যবহার করা হয়েছিল।
আমেরিকা ছাড়া আর ও যে দেশ এই ঔষধের অনুমোদন দিয়েছে সেটা হল জাপান। গত ১মে আমেরিকা সরকার জরুরি চিকিৎসার অংশ হিসেবে রেমডেসিভির-এর অনুমোদন দেয়ার পর গত ৭ মে জাপান সরকার কেবলমাত্র মরণাপন্ন রোগী যারা কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে বেঁচে আছে সেসব করোনা রোগীদের চিকিৎসায় রেমডেসিভির-এর অনুমোদন দিয়েছে।
ব্যাপক ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল না করে, ঔষধের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া বিবেচনায় না নিয়ে জাপান সরকারের রেমডেসিভির-এর অনুমোদন জাপানিজ ডাক্তারদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানাতে জাপানের রিউকিউস (Ryukyus) বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক শিনইচিরো উয়েদা জাপানিজ সংবাদপত্র “দি আসাহি শিনবুন” কে বলেন জাপান সরকার কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় রেমডেসিভির-এর অনুমোদন দিতে অতি তৎপরতা দেখিয়েছে, এতে রোগীর ক্ষতির আশংকা রয়েছে।
এই যখন রেমডেসিভির অনুমোদনের বাস্তবতা, বাংলাদেশের একটি ঔষধ কোম্পানি ইতিমধ্যেই এই ঔষধ তৈরি করে ফেলেছে এবং বাংলাদেশ সরকার তার অনুমোদনের অপেক্ষা করছে। কোভিড-১৯ আতঙ্কে অনেকেই দ্রুত এ রোগের নিরাময় আশা করছেন এবং স্বাভাবিকভাবেই যে কোনো ওষুধের সামান্য সম্ভাবনা দেখলেই, তা ব্যবহার করার জন্য আগ্রহী হচ্ছেন। কিন্তু প্রতিটি ওষুধেরই ভাল ও মন্দ দুটি দিকই রয়েছে।
তাই এই ঔষধের অনুমোদনের আগে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে ব্যাপক পরামর্শ করে এর অনুমোদন এবং সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারকে নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
লেখক: ডা. মোহাম্মাদ আরিফ হোসেন
সিনিয়র রিসার্চ সায়েন্টিস্ট, অ্যাডভান্স ক্লিনিক্যাল রিসার্চ সেন্টার
রিসার্চ ফেলো, জিকেই মেডিকেল ইউনিভার্সিটি, টোকিও, জাপান
Leave a Reply