উচ্চ আদালতে নিষ্পত্তির জন্য ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা-সংক্রান্ত দুটি মামলার পেপারবুক তৈরির কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ২০০৪ সালের এই দিনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাকে হত্যা ও আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার উদ্দেশ্যে এ হামলা করা হয়েছিল।
সরকারি ছাপাখানায় (বিজি প্রেস) এ মামলার প্রায় সাড়ে ২০ হাজার পৃষ্ঠার এক হাজার ৮০টি পেপারবুক তৈরির পর গত ১৬ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের সংশ্নিষ্ট শাখায় জমা হয়েছে। এখন পেপারবুকের সঙ্গে মামলার মূল নথি মিলিয়ে দেখা হচ্ছে। পেপারবুকে মুদ্রণজনিত অসঙ্গতি না থাকলে শিগগিরই দুটি মামলার আসামিদের মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের (ডেথ রেফারেন্স) জন্য হাইকোর্টে বেঞ্চ নির্ধারণের নির্দেশনা চেয়ে প্রধান বিচারপতির কাছে নথি উপস্থাপন করা হবে। হাইকোর্টে বেঞ্চ নির্ধারণ হলে চলতি বছরেই শুরু হবে এ মামলার চূড়ান্ত বিচার।
এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল সমকালকে বলেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে কথা হয়েছে ইতিহাসের জঘন্যতম এই হত্যাকাণ্ড মামলার দ্রুত শুনানি শুরুর উদ্যোগ নিতে। আগামী সপ্তাহ বা আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই এ মামলার শুনানির জন্য বেঞ্চ নির্ধারণের বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে দরখাস্ত (আবেদন) করা হবে। এ সংক্রান্ত প্রস্তুতিও শুরু হয়েছে।’ চাঞ্চল্যকর এ মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ পলাতক আসামিদের দেশে ফেরত এনে রায় কার্যকরের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘পলাতক আসামিদের দেশে ফিরিয়ে আনতে যা যা করণীয় আছে, বিধি অনুযায়ী সরকারের পক্ষ থেকে তার সবই করা হবে। এ জন্য নানা প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।’ ভয়াবহ এই গ্রেনেড হামলায় আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। আহত হন দুই শতাধিক মানুষ। এ ঘটনায় হত্যা ও বিস্ম্ফোরক আইনে করা দুটি মামলায় ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর বহুল প্রত্যাশিত রায় দেন ঢাকার বিচারিক আদালত। এ রায়ের বিরুদ্ধে বিএনপির সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ মৃতুদ প্রাপ্ত ১৯ আসামির করা আপিল বর্তমানে হাইকোর্টে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। বিচারিক আদালতের রায়ে এ মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, সাবেক সাংসদ কায়কোবাদসহ ১৯ জনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদ।
সুপ্রিম কোর্টের তথ্যানুযায়ী, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হত্যা মামলায় ১৩টি ভলিউমে মোট ৫৮৫টি পেপারবুক তৈরি করা হয়েছে। যা প্রায় সাড়ে দশ হাজার পৃষ্ঠার। এর মধ্যে আপিল ২২টি ও জেল আপিল ১২টি। অন্যদিকে একুশে আগস্ট বিস্ম্ফোরক মামলায় ১১টি ভলিউমে মোট ৪৯৫টি পেপার বুক তৈরি হয়েছে, যা দশ হাজার পৃষ্ঠার। এর মধ্যে আপিল ১৭টি এবং জেল আপিল ১২টি। বর্তমানে মামলার মূল নথির সঙ্গে পেপার বুক যাছাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। রাষ্ট্রপক্ষে ডেথ রেফারেন্স সংক্রান্ত আবেদনের শুনানির বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘এই মামলার বিচার যাতে না হয়, আসল আসামিরা যাতে ধরা না পড়ে সে জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়েছিল। কাজেই মামলাটির শুনানি যাতে অগ্রাধিকারভিত্তিতে করা হয়, সে জন্য আদালতের কাছে প্রার্থনা করা হবে। করোনাজনিত পরিস্থিতিতে প্রয়োজনে ভার্চুয়াল আদালতে শুনানি করা হবে।’
শুনানির জন্য প্রস্তুত ১০৮০টি পেপারবুক :ফৌজদারি কার্যবিধির ৩১ ধারা অনুযায়ী জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারকরা যে কোনো দণ্ড দিতে পারেন। তবে কেবল মৃত্যুদণ্ড দিলে সেটি হাইকোর্টে অনুমোদন করাতে হয়। তাই বিচারিক আদালত রায়ের পর ফৌজদারি কার্যবিধির (সিআরপিসি) ৩৭৪ ধারা অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মামলার সব নথি হাইকোর্টে পাঠিয়ে দেন, যা ‘ডেথ রেফারেন্স’ নামে পরিচিত। এ নথি আসার পর হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স শাখা মামলার পেপারবুক তৈরি করেন। পেপারবুকে মামলার এজাহার, অভিযোগপত্র, জব্দ তালিকা, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন, সাক্ষীদের জবানবন্দি, জেরা ও বিচারিক আদালতের রায় পর্যায়ক্রমে সাজানো থাকে। পেপারবুক তৈরি হওয়ায় এ মামলার শুনানিতে আর কোনো বাধা নেই।
ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী মোহাম্মদ খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য হাইকোর্টে বর্তমানে তিনটি বেঞ্চ নির্ধারিত রয়েছে। এর মধ্যে যে কোনো বেঞ্চে যদি শুনানির জন্য ধার্য হয়, তাহলে শিগগিরই শুনানি হতে পারে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষকেই উদ্যোগী হতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘হাইকোর্টে প্রতিটি সাক্ষ্যের চুলচেরা পর্যালোচনা করা হয়। তা ছাড়া এর সঙ্গে আসামিদের অনেকগুলো আপিলও আছে। সেটিও শুনানির সময় বিশ্নেষণ করা হবে। কাজেই এই মামলার শুনানিতে দীর্ঘ সময় লাগবে।
চাঞ্চল্যকর এ মামলার শুনানির জন্য সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের পরবর্তী ধাপ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র হাইকোর্টের স্পেশাল অফিসার মো. সাইফুর রহমান বলেন, পেপারবুকের সঙ্গে মামলা দুটি মূল নথি এখন মিলিয়ে দেখা হচ্ছে। মুদ্রণজনিত কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তা সংশোধন করা হবে। নয়তো পেপারবুক তৈরি হয়েছে জানিয়ে মামলাটি শুনানির জন্য হাইকোর্টে বেঞ্চ নির্ধারণের নির্দেশনা চেয়ে প্রধান বিচারপতির কাছে নথি উপস্থাপন করা হবে। প্রধান বিচারপতির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, মামলায় পলাতক আসামি থাকলে তাদের পক্ষে শুনানির জন্য আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবীও নিয়োগ করা হবে।
দ্রুত ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তির অতীত নজির :চাঞ্চল্যকর ডেথ রেফারেন্স মামলাগুলো অগ্রাধিকার দিয়ে নিষ্পত্তির নজির নতুন নয়। আগেও এ ধরনের মামলাগুলোতে প্রধান বিচারপতির নির্দেশনায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পেপারবুক তৈরি করা হয়েছে। ২০১৪ সালের আগে বিজি প্রেস থেকেই সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন সব পেপারবুক প্রস্তুত করত। তবে চাঞ্চল্যকর বিডিআর হত্যা মামলার রায়ে ১৫২ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পর এ মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির বিষয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ের পরামর্শে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পেপারবুক তৈরির উদ্যোগ নেয় সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। বর্তমানে বিজি প্রেসের পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্টের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায়ও পেপারবুক তৈরি করা হচ্ছে।
অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পেপারবুক তৈরির পর গত এক দশকে কমপক্ষে ২০টি চাঞ্চল্যকর মামলা হাইাকোর্টে নিষ্পত্তি করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুন মামলা, সৌদি রাষ্ট্রদূত খালাফ হত্যা মামলা, সিলেটের শিশু সামিউল আলম রাজন ও খুলনার শিশু রাকিব হাওলাদার হত্যা মামলা, রাজধানীর মালিবাগে পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমান হত্যা মামলা, চট্টগ্রামের আলোচিত ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা, ২০০০ সালের ২০ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা মামলা অন্যতম। কয়েকটি মামলা ইতোমধ্যে আপিল বিভাগেও নিষ্পত্তি হয়েছে।
মামলা নিষ্পত্তিতে বিশেষ বেঞ্চ :সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা গেছে, হাইকোর্টে বর্তমানে ২০১৫ সালের ডেথ রেফারেন্স মামলার শুনানি চলছে। করোনা পরিস্থিতিতে তিনটি বিশেষ বেঞ্চে ডেথ রেফারেন্স মামলাগুলোর শুনানি ও নিষ্পত্তি হচ্ছে। গ্রেনেড হামলার মামলাটি ২০১৮ সালে হাইকোর্টে নথিভুক্ত হওয়ায় ক্রমানুসারে আরও পাঁচ বছর পর শুনানির জন্য হাইকোর্টের কার্যতালিকায় আসার কথা। তবে প্রধান বিচারপতির উদ্যোগে দ্রুত এই মামলার পেপারবুক তৈরি হওয়ায় চলতি বছরেই এর শুনানি শুরু হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, ‘অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ডেথ রেফারেন্স মামলা নিষ্পত্তির নজির সুপ্রিম কোর্টে নতুন নয়। অতীতের চাঞ্চল্যকর মামলাগুলোর ধারাবাহিকতায় একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার পেপারবুক তৈরিতেও প্রধান বিচারপতি পদক্ষেপ নিয়েছেন। আশা করছি, এবারও তিনি এ মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বেঞ্চ গঠন করে দেবেন। সুপ্রিম কোর্টের তথ্যানুযায়ী, এক হাজার তিনশ’টি মামলায় মৃত্যুদ প্রাপ্ত এক হাজার সাতশ’র বেশি আসামির আপিল বর্তমানে উচ্চ আদালতে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।
পরিপ্রেক্ষিত :২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় হত্যা ও বিস্ম্ফোরক আইনে পুলিশ বাদী হয়ে মতিঝিল থানায় দুটি মামলা করে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে এ ঘটনার প্রথম থেকেই হামলাকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। সাজানো হয় ‘জজ মিয়া’ নাটক। তবে সময়ের পরিক্রমায় ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় গ্রেনেড হামলা মামলার পুনর্তদন্ত শুরু হলে বেরিয়ে আসতে থাকে অনেক তথ্য। তদন্ত শেষে সিআইডির এএসপি ফজলুল কবীর ২০০৮ সালের ১১ জুন দুই মামলায় অভিযোগপত্র দেন। এতে বিএনপি নেতা আবদুস সালাম পিন্টু, তার ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন ও হরকাতুল জিহাদ (হুজি) নেতা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনকে আসামি করা হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। ২০১১ সালের ৩ জুলাই তারেক রহমানসহ ৩০ জনকে আসামি করে সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করা হয়। এ নিয়ে মামলায় মোট আসামির সংখ্যা হয় ৫২।
আসামিদের মধ্যে যুদ্ধাপরাধ মামলায় জামায়াতে ইসলামী নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও সিলেটে ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীকে হত্যাচেষ্টা মামলায় হুজি নেতা আবদুল হান্নান ও শরীফ শাহেদুল ইসলাম বিপুলের মৃত্যুদ কার্যকর হয়েছে। তাই এ মামলা থেকে তাদের নাম বাদ পড়েছে। এরপর দুটি মামলায় শুনানি শেষে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর সাবেক প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে ‘ডাবল’ মৃত্যুদণ্ড দেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১। তাদের মধ্যে অধিকাংশই দেশীয় ও আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের শীর্ষ নেতা। একই অপরাধে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে ‘ডাবল’ যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয়। এ ছাড়া ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন আদালত।
রায়ে বলা হয়, এ হামলার প্রস্তুতিপর্বে হাওয়া ভবনের বৈঠকে তারেক রহমান জঙ্গিদের সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন। হামলার প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল শেখ হাসিনাকে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করা। ২০১৮ সালের ২৭ নভেম্বর বিচারিক আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ পায়। তারপর তা হাইকোর্টে পাঠানো হয়।
Leave a Reply