কক্সবাজারের টেকনাফ থানার অপসারিত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও তার বিশেষ টিমের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি আর ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে মুখ খুলতে শুরু করেছেন স্থানীয়রা। অনেকে এও বলছেন, সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা মামলায় প্রদীপ কারাগারে গেলেও তার ‘টর্চার সেলের’ সদস্যরা এখনও টেকনাফ থানায় বহাল আছেন। তারা দীর্ঘদিন প্রদীপের অপকর্মের সঙ্গী ছিলেন। তারাও নিরীহ মানুষকে ফাঁসিয়েছেন। দ্রুত ওই পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছেন স্থানীয়রা।
তারা বলছেন, টেকনাফ এলাকায় মাদক নিয়ন্ত্রণে জিরো টলারেন্স নীতি যেমন দেখাতে হবে, তেমনি নিরীহ কেউ যাতে হয়রানির শিকার না হন, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। অভিযোগ উঠেছে, মাদক নির্মূলের আড়ালে বাণিজ্য করে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হন প্রদীপ।
এদিকে মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার সাত পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার তাদের বরখাস্ত করা হয় বলে জানা গেছে। বরখাস্ত হওয়া পুলিশ সদস্যরা হলেন প্রত্যাহার হওয়া ওসি প্রদীপ, সিনহাকে গুলি করা হত্যাকারী পুলিশের পরিদর্শক লিয়াকত আলী, উপপরিদর্শক নন্দ দুলাল রক্ষিত, সহকারী উপপরিদর্শক লিটন মিয়া এবং কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন ও আবদুল্লাহ আল মামুন।
এ ছাড়া সিনহার নিহত হওয়ার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় দু-এক দিনের মধ্যে প্রদীপসহ সাত আসামিকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করবে র্যাব। সিনহার বোনের মামলায় বৃহস্পতিবার কক্সবাজার আদালতে সাত পুলিশ সদস্য আত্মসমর্পণ করেন। এরপর শুনানি শেষে সাত পুলিশ সদস্যের সাত দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। বর্তমানে প্রদীপসহ পুলিশের সাত সদস্য কারাগারে আছেন। কক্সবাজারে র্যাব-১৫-এর উইং কমান্ডার আজিম আহমেদ সমকালকে বলেন, মামলার জব্দ আলামত এখনও হাতে পাওয়া যায়নি। ১০ কার্যদিবসের মধ্যে জিজ্ঞাসাবাদ শেষ করতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
সূত্র জানায়, সিনহার বোন ৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা করলেও দু’জন বৃহস্পতিবার আত্মসমর্পণ করেননি। ওই দু’জনের নাম ভুলবশত এজাহারে লেখা হয়েছে কিনা, যাচাই করা হচ্ছে। এএসআই টুটুল ও কনস্টেবল মোস্তফা নামে দুই পুলিশ সদস্য সত্যি সত্যি বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে রয়েছেন কিনা, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, প্রদীপ ও তার পরিবারের সদস্যদের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করেছে একাধিক সংস্থা। বিদেশে তার বাড়ি রয়েছে বলে একটি সূত্র বলছে। প্রদীপের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কারও বিদেশি পাসপোর্ট রয়েছে কিনা, তারও অনুসন্ধান চলছে।
টেকনাফের স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, বিশ্বস্ত দুটি টিমের মাধ্যমে ওসি প্রদীপ তার সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন। প্রদীপের টিমের নাম ছিল ‘ওসির টিম’। টিমের সদস্যদের দিয়ে প্রদীপ তার নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতেন। প্রদীপের বিশেষ টিমে ছিলেন এএসআই সজিব দত্ত ওরফে সঞ্জিত, মিঠুন ভৌমিক, কনস্টেবল সাগর দে, নামজুল ও রাজু মজুমদার। আরও ছিলেন এসআই সুজিত, এসআই মশিউর, এসআই কামরুজ্জামান, এএসআই আমির, রাম, কাজী মোহাম্মদ সাইফ এবং কনস্টেবল রুবেল, মিথুন ও শরিফুল।
এসব পুলিশ কর্মকর্তার প্রতিজনের ছিল এক একটি নোহা গাড়ি। এ গাড়ি দিয়ে লোকজনকে আটক করে রাতে থানার তিনতলায় টর্চার সেলে নিয়ে যেতেন। ওই সেলে নেওয়ার জন্য আলাদা দরজা ব্যবহার করতেন, যাতে সিসিটিভিতে কোনো প্রমাণ না থাকে। এই টর্চার সেলে নিয়ে দাবি করা টাকা না পেলে অনেককে মেরিন ড্রাইভে নিয়ে ‘ক্রসফায়ার’ দেওয়ার হুমকি দিতেন।
এদিকে বৃহস্পতিবার টেকনাফ থানায় সরকার গঠিত তদন্ত দল আসার খবর পেয়ে থানার সামনে ভিড় জমান এলাকার কিছু সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি। প্রদীপ দাশ ও অন্য পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে আসেন তারা। তবে তদন্ত দল তাদের কথা শোনেনি।
টেকনাফের সাবরাংয়ের মকবুল আহমেদ অভিযোগ করেন, তার ভাই হাসান আহমেদকে দিনের বেলায় ধরে নিয়ে আসেন এসআই সঞ্জিত। এরপর ‘ক্রসফায়ার’ দেওয়ার হুমকি দিয়ে এই পুলিশ কর্মকর্তা তাদের কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা নেন। টাকা নেওয়ার পরও ইয়াবা দিয়ে হাসানকে কারাগারে চালান দেন। এ ঘটনাটি গত বছরের ডিসেম্বরের শেষদিকে ঘটেছে বলে দাবি করেন তিনি। মকবুল বলেন, ‘এতদিন ওসি প্রদীপ কুমার দাশের ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পাইনি। তাকে আটক করার খবর শুনে এখানে এসেছি। আমি এখন বিচার চেয়ে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে চাই।’
টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল বশর সমকালকে বলেন, প্রদীপের হয়রানি থেকে সাধারণ মানুষ আপাতত রক্ষা পেলেও তার অপকর্মের সঙ্গীরা সবাই এখনও টেকনাফ থানায় রয়েছেন। দ্রুত তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। সেটা না হলে এ চক্র আবার মানুষকে ফাঁদে ফেলবে।
Leave a Reply