পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফার ডটকমকে বলেছেন, “আমরা প্রথম দিন থেকে সতর্ক অবস্থান নিয়েছি। অপ্রয়োজনীয় যাতায়াত কমিয়ে দিয়েছি। আক্রান্তদের কেউ ক্যাম্পের ভেতরে ঢুকতে পারে নাই। সে কারণে এখনো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে।
”তবে এই অবস্থায় কত দিন রাখা যাবে, সে বিষয়ে নিশ্চিত নই। কারণ অনেকে আমাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ক্যাম্পের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছে।”
কক্সবাজার, টেকনাফ আর উখিয়ায় বেশ কয়েকটি ক্যাম্প মিলিয়ে মোট সাড়ে ৬ হাজার একর জমিতে গাদাগাদি করে বসবাস করছে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা।
সেখানে করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকানো না গেলে পরিস্থিতি যে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেবে, সে বিষয়ে শুরু থেকেই উদ্বেগ রয়েছে আন্তর্জাতিক মহলে।
বাংলাদেশে মার্চের ৮ তারিখ প্রথম রোগী শনাক্ত হওয়ার ৩৭ দিনের মাথায় কক্সবাজারে প্রথমবারের মত একজন রোহিঙ্গার শরীরে সংক্রমন ধরা পড়ে।
শুক্রবার পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের মধ্যে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে ৪৬ জন হয়েছে, মারা গেছেন ৪ জন। অন্যদিকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাইরে রেড জোন হিসাবে চিহ্নিত কক্সবাজার জেলায় শনাক্ত হয়েছেন ১ হাজার ৯২৫ জন।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর গত ১১ মার্চ থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্প অবরুদ্ধ রাখা হলেও তার মধ্যেই সংক্রমণ ঘটেছে। অবরুদ্ধ অবস্থার মধ্যে কেবল পানি, স্যানিটেশন ও খাবার বিতরণের সঙ্গে জড়িত এনজিওগুলোর কার্যক্রম সেখানে চালু আছে।
সেখানে পরিস্থিতি কতদিন নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে, সে বিষয়ে সন্দিহান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদও।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ভুটানের জনসংখ্যার সমান একটি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় এখনো পর্যন্ত করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আছে। তবে সেটা কতটুকু থাকবে এখনো বলা যাচ্ছে না।“
করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়টি যেন চাপা পড়ে না যায়, সেজন্য সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জোরালো ভূমিকা রাখার পরামর্শ দেন তিনি।
সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে কেয়ার ইন্টারন্যাশনালের ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর রাম দাস বলেন, সরকার ও আন্তর্জাতিক দাতাসংস্থার যৌথ উদ্যোগে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এখনো করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
”দেশের অন্য এলাকায় পরিস্থিতি খারাপ হলেও ক্যাম্পগুলোতে এখনো নিয়ন্ত্রিত। এটা বড় ধরনের সাফল্য। তবে এ অবস্থা কতদিন বলবৎ থাকবে, সেটা নিয়ে সংশয় আছে।”
ক্যাম্পে কম রোগী শনাক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে কম পরীক্ষা হওয়ার বিষয়টিও একটি কারণ হয়ে থাকতে পারে বলে মনে করছেন আশ্রয় শিবিরের রোহিঙ্গা নেতারা।
কুতুপালংয়ের পশ্চিম-১ ক্যাম্পের মাঝি (নেতা) মোহাম্মদ নূর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, করোনাভাইরাস পরীক্ষা নিয়ে রোহিঙ্গাদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক রয়েছে।
“অনেকে ভাবছে, রোগ ধরা পড়লে যদি পরিবার থেকে আলাদা করে দেয়। আবার আক্রান্ত হলে ভাসানচরে পাঠিয়ে দেওয়া হতে পারে, এমন ভয়ও কারও কারও মধ্যে আছে।”
শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনার কার্যালয়ের স্বাস্থ্য সমন্বয়ক ডা. তোহা ভুইয়াও বিষয়টি স্বীকার করেছেন। ক্যাম্পে এখন প্রতিদিন গড়ে ১০ জনের করোনাভাইরাস পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়া সম্ভব হচ্ছে বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন তিনি।
“নমুনা পরীক্ষা নিয়ে তাদের মধ্যে এক ধরনের ভীতি ও আতঙ্কের কথা লোকমুখেও রয়েছে। তবে চিকিৎসকদের সামনে সরাসরি বলে না।”
আশ্রয় শিবিরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পরীক্ষা কার্যক্রম বাড়ানো হচ্ছে জানিয়ে ডা. তোহা বলেন, “যত বেশি টেস্ট হবে প্রকৃত চিত্র পাওয়া তত সহজ যাবে। ইতোমধ্যে সচেতনতা বাড়াতে ও সাহস জোগাতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। ক্যাম্পের মাঝি, ইমাম, পাড়ার লোকজনকে নিয়ে ক্যাম্পেইন করা হচ্ছে যেন অসুস্থ বোধ করলেই নমুনা দেওয়া হয়। তাতে সফলতাও আসছে।”
তিনি জানান, ক্যাম্পে এ পর্যন্ত ৪৫২ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে।তার রমধ্যে ৪৪ জনের ‘পজিটিভ’ এসেছে। ৩২ জন আইসোলেশন সেন্টারে রয়েছে। আক্রান্তদের মধ্যে ৪ জন মারা গেছে, তিনজন সুস্থ হয়ে উঠেছে। অন্যদের চিকিৎসা চলছে।
“মাঝখানে ল্যাবের সমস্যার কারণে নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়া বন্ধ ছিল। নানা জটিলতায় বিলম্ব হয়েছে। এখন নমুনা সংগ্রহ বাড়ছে; ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রিপোর্ট দেওয়া সম্ভব হচ্ছে।”
কোভিড-১৯ রোগীদের ভাসানচরে নেওয়ার বিষয়টি যে সত্যি নয়, সেটা তাদের বোঝাতে পারলে পরীক্ষার সংখ্যা বাড়তে পারে বলে মন্তব্য করেন ডা. তোহা।
পরীক্ষা নিয়ে রোহিঙ্গাদের ভয়ের কিছু নেই মন্তব্য করে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মাহবুব আলম তালুকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যেসব ফ্যামিলি মেম্বার বা তাদের সংস্পর্শে যারা এসেছে তাদের শনাক্ত করে কোয়ারেন্টিন সেন্টারে রাখা হচ্ছে।
“এ পর্যন্ত সাত-আটশ লোককে কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। অনেকে ভালো হয়ে ফিরে যাচ্ছে তাদের ক্যাম্পে। আমাদের তদারকি রয়েছে। ডাক্তার, নার্স, টেকনিশিয়ানসহ আনুষঙ্গিক সব সুবিধা পাচ্ছে তারা।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঘটনা বাইরের তুলনায় ‘অনেক কম’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “শূন্যের কোঠায় তো এখনই আনা যাবে না, তবে ধীরে ধীরে কমে আসবে বলেই প্রত্যাশা।”
পরিস্থিতি মোকাবেলায় ‘পর্যাপ্ত সংখ্যক’ চিকিৎসক, নার্স, আইসোলেশন ইউনিট ও কোয়ারেন্টিন সেন্টার রাখা হয়েছে বলেও জানান প্রত্যাবাসন কমিশনার।
তিনি বলেন, ক্যাম্পের ভেতরে কোভিড-১৯ আক্রান্তদের জন্য সিভিয়ার একিউট রেসপিরেটরি ইনফেকশন আইসোলেশন অ্যান্ড ট্রিটমেন্ট সেন্টার (এসএআরআই আইটিসিএস) রয়েছে। সেখানে ২০০ বেড রয়েছে। আইসোলেশন ইউনিটে বেড রয়েছে ১৮৪টি।
আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য শরণার্থী শিবিরে আরও ১৯০০ বেড প্রস্তুতের পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান এই সরকারি কর্মকর্তা।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন
রাখাইনে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গার বাংলাদেশে চলে আসার পর আড়াই বছর পার হলেও একজনকেও ফেরত নেয়নি মিয়ানমার।
’মিয়ানমারে সহায়ক পরিবেশ না থাকায়’ রোহিঙ্গাদের অনাগ্রহে গতবছর দুইবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ব্যর্থ হয়।
কক্সবাজারের বাঁশ-প্লাস্টিকের তৈরি ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গাদের মানবেতর দিন কাটছে গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে। এর মধ্যেই বিশ্বজুড়ে এসেছে করোনাভাইরাস মহামারী। ফলে এবারের বিশ্ব শরণার্থী দিবসে তাদের ফেরানোর বিষয়টি আবার নতুন করে আলোচনায় ফিরেছে।
প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু না হওয়ার জন্য মিয়ানমারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জোরালো ভূমিকা না থাকার বিষয়টিও তুলে ধরেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “গত তিন বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমার ফেরত নেয়নি। যদিও তারা আমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ফেরত নেবে। এক্ষেত্রে দুটো শর্ত ছিল- সেফটি, সিকিউরিটি অ্যান্ড ডিগনিটির সঙ্গে তাদের ফেরানো এবং রাখাইনে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করা। এর কোনোটি তারা করেনি। করোনাভাইরাসের কারণে মিয়ানমারের অন্য কোথাও সংঘাত না হলেও রাখাইনে এখনও সংঘাত চলছে।”
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমালোচনা করে মোমেন বলেন, “পৃথিবীতে যারা মানবাধিকার নিয়ে কথা বলেন, তারা দেখছেন মিয়ানমার মানবাধিকারের লঙ্ঘন করছে, তবুও তারা দেশটিতে বিনিয়োগ করে যাচ্ছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, জাপানসহ সবার বিনিয়োগ কয়েকগুণ বেড়েছে।
”তারা মুরব্বির মত কথা বলেন, রোহিঙ্গাদের বিষয়ে কথাবার্তা বলেন। আদতে কোনো কাজ করেন না।”
মানবাধিকারের বিষয়ে উচ্চকণ্ঠ দেশগুলোতে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “মানবাধিকারের বিষয়ে যারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, আপনারা এদেরকে যে কোনো সময় নিয়ে যেতে পারেন। আমরা কোনো বাধা দেব না। এক্ষেত্রে তারা আপনাদের দেশের অর্থনীতিতেও অবদান রাখতে পারবে।”
বাস্তুহারা এইসব মানুষের জন্য আরও উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, গত দুই বছরে সাত কোটি মানুষ শরণার্থী হয়েছে দেশে দেশে যুদ্ধ, সংঘাত এবং ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর কারণে।
”মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কীট পতঙ্গের মত ব্যবহার করে। তাদের মিডিয়ায় ক্রমাগত প্রচার চলে রোহিঙ্গারা মানুষই না। রোহিঙ্গারা বছরের পর বছর সংঘাত, যুদ্ধ ও হিংসা শিকার। এই প্রতিহিংসার পরিবেশ যেন না থাকে আমরা সেটা চাই।”
মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফেরানোর পরিবেশ তৈরি না করে উল্টো এখনো যারা সেখানে আছে, তাদের বিতাড়িত করার চেষ্টায় আছে বলে মন্তব্য করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ইমতিয়াজ আহমেদ।
তিনি বলেন, “এটা মেনে নেওয়া যায় না। চীন, ভারতসহ যারা মিয়ানমারের বন্ধু রাষ্ট্র আছে, তাদের এক্ষেত্রে ভূমিকা নেওয়া দরকার। কিন্তু আমরা সেভাবে কোনো উদ্যোগ দেখছি না।”
Leave a Reply