দেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ঘিরে গড়ে উঠছে ভয়ংকর ‘কিশোর গ্যাং’। আধিপত্য বিস্তারে মারামারি, নেশা, শোডাউন, ইভটিজিংসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে একশ্রেণির কিশোর। আর এসব অপরাধের অর্থের জোগানে মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, চুরিসহ নতুন অপকর্মে জড়াচ্ছে তারা। ‘ক্ষমতা জানান দিতে’ ঘটছে খুনের ঘটনাও। রাজনৈতিক ও ব্যক্তিস্বার্থে স্থানীয় প্রভাবশালীরা উঠতি বয়সী এসব তরুণকে বিভিন্ন সময় আশ্রয়প্রশ্রয় দিচ্ছেন। কেবল রাজধানী ঢাকা নয়, দেশের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে ওঠা এসব গ্যাং এখন সাধারণ মানুষের কাছে আতঙ্কের নাম।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, রাজধানীতে বিভিন্ন এলাকা ঘিরে প্রায় অর্ধশত ‘কিশোর গ্যাং’ গড়ে উঠেছে। এদের আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শক্ত প্ল্যাটফরম রয়েছে। ওবারলো ডটকমের এক পরিসংখ্যান বলছে, টিকটকের ৪১ শতাংশ ব্যবহারকারীর বয়স ১৬ থেকে ২৪ বছর। সামাজিক মাধ্যম ঘিরে সংঘটিত অপরাধের ক্ষেত্রেও এই বয়সীদের বেশি সম্পৃক্ততা পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। যাদের অধিকাংশই কিশোর।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘স্ট্যাটাস ফ্রাস্ট্রেশন’ (সামাজিক পদমর্যাদাজনিত প্রতিবন্ধকতা), অর্থলোভ, দুর্বল পারিবারিক বন্ধন ও ক্ষমতা প্রদর্শন থেকেই এসব গ্যাং গড়ে উঠছে। নিজেদের জাহির করতে ফেসবুক, টিকটক এবং লাইকির মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করছে তারা। এদের ‘শেল্টার’ দিচ্ছেন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। বিভিন্ন কর্মসূচিতে এবং অপরাধ সংঘটনেও এদের ব্যবহার করা হচ্ছে। চলাচলের জন্য কিনে দেয়া হচ্ছে বাইকের মতো পরিবহন। অনেক সময় বিনা পয়সায় দেয়া হচ্ছে মাদক। এতে কিশোরদের নৈতিক ভিত নড়বড়ে হচ্ছে। জড়িয়ে পড়ছে খুনসহ ভয়ংকর সব অপরাধে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান যুগান্তরকে বলেন, আশি ও নব্বইয়ের দশকে রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদর্শনকে কেন্দ্র করে কিশোর অপরাধের অসংখ্য ঘটনা দেখা গেছে। এখনও এমন ঘটনা আছে। তবে বর্তমানে যেসব কিশোর অপরাধ হচ্ছে বা ‘কিশোর গ্যাং’ গড়ে উঠছে, এর বেশির ভাগই ‘লাইফস্টাইল’ কেন্দ্র করে। যেখানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহার এবং গেম খেলার মতো বিষয়ও রয়েছে। আমরা যেভাবে বন্ধুরা মিলে গল্প-আড্ডা দিই, সেভাবে তারাও শুরুতে বিনোদন হিসেবেই ‘গ্যাং’ গড়ে তুলছে। এরপর জড়িয়ে যাচ্ছে মাদকসেবন, মাদক ব্যবসা, ছিনতাই, খুনসহ বিভিন্ন অপরাধে।
সম্প্রতি রাজধানী এবং এর বাইরের কয়েকটি কিশোর অপরাধের ঘটনা বেশ আলোচিত হয়। এর মধ্যে ২ আগস্ট উত্তরা ৮ নম্বর সেক্টরে টিকটিক ভিডিও নির্মাতা ইয়াসীন আরাফাত অপু ওরফে ‘অপু ভাই’-এর অনুসারীদের হামলায় পথচারীর মাথা ফেটে যাওয়ার ঘটনাটি দেশজুড়ে আলোচনায় ছিল। এ ঘটনায় উত্তরা পূর্ব থানায় ভুক্তভোগীর মামলায় ৩ আগস্ট অপু ও তার সহযোগী নাজমুলকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ইয়াসীন আরাফাত অপু ‘টিকটক অপু’ ও ‘অপু ভাই’ নামে পরিচিত। রং করা ঝাঁকড়া চুলের এই কিশোরের টিকটকে বিপুলসংখ্যক অনুসারী আছে। নোয়াখালী থেকে ঢাকা আসা এই কিশোরের আশ্রয়দাতা ছিল ঢাকার উত্তরার কিশোর গ্যাংয়ের তিন নেতা সাকিল, শাহাদাত ও সানি। নোয়াখালীর সোনাইমুড়িতে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ুয়া অপু একসময় সেলুনে কাজ করত। এরপর ভিডিও শেয়ারিং অ্যাপ লাইকি এবং টিকটকের ভিডিওতে আসক্ত হয় সে। ছোটবেলায় মা-বাবা আলদা হয়ে যাওয়া এই কিশোর এরপর পরিচিত হয় ‘অপু ভাই’ হিসেবে। পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) নাবিদ কামাল জানান, ‘টিকটক অপু’ ও তার সঙ্গীরা কিশোর গ্যাং হিসেবে আত্মপ্রকাশের চেষ্টা চালাচ্ছিল।
চলতি মাসে খবর আসে চট্টগ্রামের উড়ালসড়কে ‘কিশোর গ্যাং’-এর ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়ার। ২৮ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত আট দিনে নগরের উড়ালসড়কের আশপাশে অভিযান চালিয়ে এই চক্রের ৪৪ জনকে গ্রেফতার করে র্যাব-পুলিশ। যাদের বেশির ভাগই শিশু-কিশোর। তাদের কাছ থেকে ছিনতাইয়ে ব্যবহৃত ছুরি, রড ও সুতা পাওয়া যায়। এদের বেশির ভাগই নেশায় জড়িত এবং পরিবারছাড়া।
পুলিশ বলছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লাগাতার অভিযানে কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতা আগের চেয়ে কমেছে। এদের বেশকিছু গ্রুপকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। ব্যবস্থা করা হয়েছে সংশোধনের। সর্বোপরি কিশোর গ্যাংয়ের মূলোৎপাটনে পুলিশ কাজ করছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, কিশোর অপরাধ দমনে র্যাব সব সময় সচেষ্ট। দেশজুড়ে কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতা রোধে আমরা কাজ করছি। কখনও তাদের সংশোধনে সহায়তা করছি।
কিশোর অপরাধের এই ধারা এবং এর প্রতিকারের বিষয়ে জানতে চাইলে অপরাধবিজ্ঞানী ড. জিয়া রহমান বলেন, পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হওয়া, আকাশ সংস্কৃতি ও মডার্নাইজেশন এসব অপরাধের অন্যতম কারণ। এখনই এসব সমস্যা নিরসনে উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের কিশোর সংশোধন কেন্দ্রগুলোয় কোনো কাজ হয়না বললেই চলে। এগুলো গুরুত্ব দিয়ে কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি কিশোরদের বেশি করে ‘ভলান্টারি’ কাজে যুক্ত করতে হবে। খেলাধুলার যথেষ্ট সুযোগ তৈরি কতে হবে। ‘স্ট্যাটাস ফ্রাস্ট্রেশন’-এর বিষয়টি খেয়াল রেখে নিুবিত্ত পরিবারের কিশোরদের বিশেষ যত্ন নিতে হবে। পাশাপাশি পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এসব বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
Leave a Reply