মামলার অগ্রগতি নিয়ে হতাশ নিলয়ের স্ত্রী আশা মনি বলেছেন, “দিন দুপুরে একজন মানুষকে খুন করা হল। পাঁচ বছরেও মামলার তদন্তই শেষ হল না। বিচারের জন্য আর কত বছর অপেক্ষা করতে হবে?’
দেশজুড়ে উগ্রবাদীরা একের পর পর ‘টার্গেট কিলিং’ শুরুর পর ২০১৫ সালের ৭ অগাস্ট শুক্রবার ছুটির দিনের শান্ত দুপুরে জুমার নামাজ শেষ হওয়ার পরপরই খিলগাঁওয়ের পূর্ব গোড়ান টেম্পোস্ট্যান্ডের কাছে ৮ নম্বর রোডের ১৬৭ নম্বরের পাঁচতলা ভবনের পঞ্চমতলায় নিলয়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ২৭ বছর বয়সী ব্লগার নিলয় ইস্টিশন ব্লগে লিখতেন নিলয় নীল নামে। খুন হওয়ার কিছু দিন আগে হুমকি পাওয়ার কারণে ফেইসবুক থেকে নিজের সব ছবি সরিয়ে ফেলার পাশাপাশি ঠিকানার জায়গায় বাংলাদেশের বদলে লিখেছিলেন ভারতের কলকাতার নাম।
নিরাপত্তাহীনতার কথা জানিয়ে নিলয় হত্যাকাণ্ডের আড়াই মাস আগে জিডি করতে গেলেও থানা তা নেয়নি বলে ফেইসবুকে এক পোস্টে লিখে যান তিনি।
ঘটনার বিবরণে আশা মনি জানান, দুপুরে জুমার নামাজের পরপর দুই দফায় চারজন লোক বাসা দেখতে আসার কথা বলে ওই বাসায় ঢোকে। তারা নিলয়কে কুপিয়ে হত্যা করে চলে যায়।
নিলয়কে কোপানোর সময় এক হামলাকারীর পা জড়িয়ে ধরেছিলেন আশা মনি। এরপর তাকে চুল ধরে টেনে নিয়ে বারান্দায় আটকে রাখা হয়।
আশার ছোট বোন ইশরাত তন্বীও ঘটনার সময় ওই বাসায় ছিলেন। চিৎকার করায় তাকেও আটকে ফেলা হয় আরেক পাশের বারান্দায়। ঘাড় ও গলায় কুপিয়ে পাঁচ থেকে সাত মিনিটের মধ্যে নিলয়ের মৃত্যু নিশ্চিত করে হামলাকারীরা। ‘নারায়ে তাকবির’ ধ্বনি দিয়ে চলে যায় তারা।
এই হত্যাকাণ্ডের খবর গণমাধ্যমে আসার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা শাহবাগে মিছিল করে নিলয়ের হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবি জানান।
২০১৫ সালের ৭ অগাস্ট শুক্রবার জুমার নামাজের পর খিঁলগাওয়ের গোড়ানের বাসায় ঢুকে কুপিয়ে হত্যা করা হয় নিলয়কে।
হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক রবার্ট ওয়াটকিনস এক বিবৃতিতে খুনিদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান। এ ধরনের হত্যা বন্ধে বাংলাদেশ সরকারকে ‘কঠোর হওয়ার’ আহ্বান জানায় মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।হত্যাকাণ্ডের ঘণ্টা চারেক পর আল কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশের (একিউআইএস) বাংলাদেশ শাখা, আনসার আল ইসলামের নামে সংবাদপত্র অফিসে ই-মেইল পাঠিয়ে দায় স্বীকার করা হয়।
নিহত নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয়ের বাড়ি পিরোজপুর জেলার চাল্লিশা গ্রামে। বাবা তারাপদ চট্টোপাধ্যায় নিজের কৃষি জমি দেখাশোনা করেন। নিলয় কাজ করতেন একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায়।
ঘটনার দিন রাত সাড়ে ১১টার দিকে নিলয়ের স্ত্রী আশা মনি অজ্ঞাতপরিচয় চারজনকে আসামি করে খিলগাঁও থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।
এই মামলায় ১২ আসামিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাদের মধ্যে শেখ আব্দুল্লাহ, খায়রুল ইসলাম, সাকিব ওরফে সাদ্দাম, আরাফাত হোসেন ও মোজাম্মেল হোসেন কারাগারে আছেন। আর কাউসার হোসেন, সাদ আল নাহিন, আরিফুল আযম, মাসুদ রানা, মর্তুজা সাব্বির, মাওলানা মুফতি আবদুল গফুর ও কামাল হোসেন উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন। এদের মধ্যে সাদ আল নাহিন জাতীয় পার্টির নেতা ও সাবেক শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নুর ভাতিজা।
আশা মনি বৃহস্পতিবার আদালতপাড়ার সাংবাদিকদের বলেন, “প্রতি বছর এ সময় অনেকে খোঁজ-খবর নেয়। সাংবাদিকরা যোগাযোগ করে। ২-৩ দিন যাওয়ার পর আবার সব কিছু আড়ালে চলে যায়। এভাবেই তো কেটে গেল পাঁচ বছর। এখনও মামলার তদন্ত শেষ হল না। বিচার কবে হবে?”
তিনি বলেন, “কারা তাকে খুন করল? আমি বিচার চাই। যে চলে গেছে সে তো আর ফিরে আসবে না। তাই হত্যাকারীদের উপযুক্ত সাজা চাই।”
পুলিশ তৎপর হলে মামলার এই অবস্থা হত না মন্তব্য করে আশা মনি বলেন, “মামলা তদন্তে দীর্ঘসূত্রতায় অবশ্যই সরকারের দায়ভার রয়েছে। অনেক আসামি জামিনে বেরিয়ে যাচ্ছে। এই হত্যার তদন্ত ও বিচারে কালক্ষেপণ পরোক্ষাভাবে জঙ্গিবাদকে উৎসাহ জোগাবে।
“নিজ চোখে সেদিনের ঘটনা আমি দেখেছি। আমাকেও তারা খুন করতে পারে। ঘর থেকে বের হলে আতঙ্ক কাজ করে।”
দ্রুত এই হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করে ব্লগার আরিফ জেবতিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এসব ক্ষেত্রে আইনের শাসন যদি শক্তভাবে প্রযোজিত না হয় তবে আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের দেশ ভাবমূর্তি হারাবে।”
তিনি বলেন, “পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটকে এ বিষয়গুলো যথাযথ মনোযোগ দিয়ে দেখতে হবে। এসব হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনাল সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হলেও দ্রুত বিচার নিষ্পন্নে গুরুত্ব দেখা যায়নি।
“রাষ্ট্রপক্ষে একাধিক দক্ষ আইনজীবীর সমন্বয়ে আরও লজিস্টিক সুবিধা দিয়ে শক্তিশালী প্রসিকিউশন সেল গঠন করে এসব মুক্তচিন্তার লেখক, কবি, সাংবাদিক হত্যার সুষ্ঠু বিচার করা না হলে দেশ মধ্যযুগীয় অন্ধকারে চলে যাবে।”
তদন্তে দীর্ঘসূত্রতার কারণেই গ্রেপ্তারদের সাতজন জামিনে ছাড়া পেয়েছেন বলে মনে করেন আইনজীবী ও গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক জীবনানন্দ চন্দ জয়ন্ত।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোনো ফৌজদারি মামলার আসামির জামিন পাওয়ার একটি অন্যতম শর্ত হচ্ছে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমায় বিলম্ব হওয়া। আরকেটি হচ্ছে মামলার বিচারে দিনের পর দিন আদালতে সাক্ষী হাজির না হওয়া। নিলয় হত্যা মামলায় প্রথম শর্ত পূরণ হওয়ায় বেশিরভাগ আসামি জামিন পেয়ে গেছে। অবশিষ্টরাও জামিন পেয়ে যাবে বলে আমরা আশঙ্কা করছি।
“জামিন পেয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে আগের চেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর কাণ্ডে তারা জড়িয়ে পড়তে পারে। একুশে অগাস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার বিচারেও ভীষণ রকমের বিলম্ব হয়েছে। সিপিবির সমাবেশে গ্রেনেড হামলা, উদীচীর সমাবেশে হামলা মামলার নিষ্পত্তিতেও যুগ পেরিয়ে গেছে।”
আইনজীবী জয়ন্ত বলেন, “স্পশর্কাতর ও সারা বিশ্বে নাড়া দেওয়া এই সব ঘটনায় দ্রুত তদন্ত প্রতিবেদন-অভিযোপত্র জমা না পড়া জঙ্গিদেরই সাহস যোগাবে। আস্তে ধীরে এ সব হত্যাকাণ্ড গা সওয়া হয়ে যাবে। জঙ্গিবাদকে সহনশীল জায়গায় নিয়ে যাবে।”
দীর্ঘ দিন এই মামলার তদন্তের দায়িত্বে থাকা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক প্রদীপ কুমার এই মামলায় তাদের পক্ষে সবশেষ তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন। মামলার অগ্রগতি জানতে তার মোবাইলে ফোন করলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।
পরে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মো. মনিরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মামলাটি এতদিন গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত করছিল। বর্তমানে মামলাটি তাদের কাছে।
তদন্তের অগ্রগতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আসামি সব শনাক্ত হয়েছে। শিগগিরই চার্জশিট দাখিল করা হবে।”
Leave a Reply